উত্তরাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমেও পানির অভাবে নেই দেশীয় প্রজাতির মাছ

(নওগাঁ) প্রতিনিধি: “আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভর ভর , মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর, চারিদিকে বনে বনে পরেযায় সারা, বর্ষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।” খোদ বর্ষা মৌসুমের আষাঢ় মাসের ২২ পেরিয়ে গেলেও উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির পানির তেমন দেখা নেই।

এ অঞ্চলের নদী নালা, খাল বিল, জলাশয়, পুকুর, ডোবায় পানির অভাবে ধরা পরছেনা দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। ২৫-৩০ বছরে দেশীয় ২৬০ প্রজাতির মধ্য থেকে ৬৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত প্রায়। প্রাকৃতিক উৎসের মাছ কমে গেলেও হাইব্রিড মাছের উৎপাদন বেড়ে গেছে। ফলে দেশীয় আরো শতাধিক প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিদেশী মাত্র ¬২৪ প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষের ব্যাপকতায় দেশীয় আড়াই শতাধিক প্রজাতির মাছ অস্তিত্বের হুমকিতে পড়েছে। কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে খাল-বিল, জলাশয়ের স্বচ্ছ পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ে। আর বিষাক্ত পানির কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে হাইব্রিড জাতের সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মিরর কার্প, কমন কার্প, বিগহেড, থাই সরপুঁটি, থাই কৈ, থাই পাঙ্গাস, ব্যাক কার্প, পাঁচ প্রজাতির তেলাপিয়াসহ ২৪ প্রজাতির মাছ চাষ হচ্ছে। হাইব্রিড জাতের মাছ চাষের আগে পুকুর ডোবার পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোয় মাছ, শামুক ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজননক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, অধিক মুনাফার আশায় হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে জলাশয়গুলো থেকে দেশীয় মাছের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। এক সময়ের অতি পরিচিত দেশী প্রজাতির মাছ বিশেষ করে কৈ, মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল,মৃগেল, চিতল, রিটা, গুজি আইড়, পাঙ্গাস, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু দেশীয় মাছগুলো এখন আর তেমন দেখা যায় না।

ফলি, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, রানি, পুতুল, টেংরা, পাবদা, পুঁটি, সরপুঁটি, চেলা, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, গোঙসা, রায়াক, রয়না, বাতাসি, বাজারি, বেলেসহ ৬৫ প্রাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। কোনো কোনো মাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পথে। কোনো কোনো মাছ বংশসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।

রাজশাহী ও রংপুর মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ খাঁড়ি রয়েছে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার। পুকুর রয়েছে ৭৪ হাজার ৯৫৪ হেক্টর। নদী, শাখা নদী ও উপনদী রয়েছে ২৯০টি। খাল ১১ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর, বিল ৩৩ হাজার ৬৪৯ হেক্টর ও প্যাবন ভূমি রয়েছে ৬ লাখ ৯ হাজার ৯৮২ হেক্টর। মানুষের সৃষ্ট পরিবেশগত পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতিতে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় জলাশয়ে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নদী, বিল ও জলাশয় থেকে দেশীয় মাছ হারিয়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পানিস্বল্পতা, যেখানে সেখানে বাঁধ নির্মাণ, নাব্যতা হারানো, পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ শিকার, মাছের নিরাপদ আশ্রয় না থাকা ও প্রজননত্রে সঙ্কুচিত হওয়া, প্যাবনভূমির সাথে সংযোগ খালগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, খরা ও অনাবৃষ্টি, জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাছের বংশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নদীতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ না থাকায়ও প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এসব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এরপরও নদীনালা, খাল-বিল ও জলাশয়গুলোয় যে পরিমাণ মাছ সঞ্চিত থাকে তা নির্বিচারে শিকারের ফলে দিন দিন দেশী প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।

মৎস্য বিভাগ জানায়, উত্তরাঞ্চলের পদ্মা, যমুনা, বড়াল, আত্রাই, কাকেশ্বরী, সুতিখালি, ইছামতি, করতোয়া, গোহালা, চিকনাই, ধরলা, দুধকুমার, তিস্তা, ঘাঘট, ছোট যমুনা, নীলকুমার, বাঙ্গালী, বড়াই, মানস, কুমলাই, সোনাভরা, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, মহানন্দা, টাঙ্গান, কুমারী, পুনর্ভবা, ত্রিমোহনী, তালমা, ঢেপা, বুরুম, কুলফি, বালাম, ভেরসা, ঘোড়ামারা, পিছলাসহ দুই শতাধিক নদী, শাখা নদী, উপনদী, চলনবিল, ঘুঘুদহ বিল, গাজনার বিল, শিকর বিল, হাড়গিলার বিল, দীঘলাছড়ার বিল, বোছাগাড়ীর বিল, ইউসুফ খাঁর বিল, নাওখোয়া বিলসহ এক হাজার ৮০০টি বিল এক সময় মাছের ভান্ডার ছিল।

কিন্তু এসব নদী, নালা, খাল-বিল খনন ও সংস্কার না করায় দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে কমে গেছে মাছের বংশবৃদ্ধি ও উৎপাদন। সূত্র জানায়, এক সময়ের মৎস্যভান্ডার চলনবিলের বর্তমান অবস্থা এখন করুণ।

অনেক আগেই বিলের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। শুকনো মওসুমের আগেই শুকিয়ে গেছে চলনবিলের নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়। বিলে পানি না থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে মাছ উৎপাদন। ছোট-বড় ৩৯টি বিল নিয়ে চলনবিল। এসব বিলের মধ্যে ১৬টি নদী, ২২টি খালসহ অসংখ্য পুকুর রয়েছে। নওগাঁ, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও রাজশাহী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত চলনবিলে ৭৭ হাজার ৭৩৩ হেক্টর আয়তনের পাবন ভূমি রয়েছে।

এখন চলনবিলের নদী, খাল-বিল, জলাশয় ও পুকুর প্রায় পানিশূন্য। ফলে মাছ উৎপাদনে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) ২০০০ সালে ৫৪ প্রজাতির মাছকে বিপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। আইইউসিএন বিপন্ন প্রজাতির সব মাছকে সঙ্কটাপন্ন, বিপন্ন, চরম বিপন্ন ও বিলুপ্ত এ চার ভাগে ভাগ করেছে।

সঙ্কটাপন্ন মাছের মধ্যে আছে ফলি, বামোশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, আইড়, গুলশা, কাজুলি, গাং মাগুর, কুচিয়া, নামাচান্দা, মেনি, চ্যাং ও তারাবাইম। বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে চিতল, টিলা, খোকশা, অ্যালং, কাশ খাইরা, কালাবাটা, ভাঙন, বাটা, কালিবাউশ, গনিয়া, ঢেলা, পাবদা, ভোল, দারকিনি, রানি, পুতুল, গুজি আইড়, টেংরা, কানিপাবদা, মধুপাবদা, শিলং, চেকা, একঠোঁট্টা, কুমিরের খিল, বিশতারা, নেফতানি, নাপিত কৈ, গজাল ও শাল বাইন।

অন্য দিকে চরম বিপন্ন প্রজাতির মাছের তালিকায় রয়েছে ভাঙন, বাটা, নান্দিনা, ঘোড়া মুইখ্যা, সরপুঁটি, মহাশোল, রিটা, ঘাইড়া, বাছা, পাঙ্গাস, বাঘাইড়, চেনুয়া ও টিলাশোল মাছের নাম।

উত্তরাঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণমতা হারিয়ে ফেলছে। সরকারি উদ্যোগে এ অঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় পুনঃখননের মাধ্যমে পানির ধারণমতা বাড়ানোর দাবি উত্তরাঞ্চলের মৎস্য চাষিদের।

আপনি আরও পড়তে পারেন